ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানার আগে থেকেই জোয়ারের পানি উঠতে শুরু করে নদীবেষ্টিত বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়নজুড়ে। নদী তীরবর্তী ঘষিয়াখালী, ফুলহাতা, বহরবুনিয়া গ্রামের পুরোটাই ডুবে যায় পানিতে। বেড়িবাঁধ না থাকায় এই অঞ্চল ঝড় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ডুবেছে কয়েকবার।
বাগেরহাট শহর থেকে সড়কপথে রামপাল উপজেলার মল্লিকের বের খেয়াঘাটের অপরপাশে ঘষিয়াখালী লঞ্চঘাট। খেয়াপাড় হয়ে লঞ্চঘাট থেকে ওপরে উঠলেই বহরবুনিয়া ইউনিয়নের ঘষিয়াখালী বাজার। বাজারের রাস্তার পাশেই রয়েছে জেলা পরিষদের বিশালাকৃতির এক পুকুর। এই পুকুরের পানি পান ও রান্নার কাজে ব্যবহার করেন স্থানীয়রা। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়েছে পুকুরটি।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের এক সপ্তাহ পর ঘষিয়াখালী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সুপেয় পানির একমাত্র উৎস সেই পুকুরটির দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ১০০ ফুটের বেশি পাড় ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে। দক্ষিণপাড়ের মাঝখান দিয়েও প্রায় ৫০ ফুট ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে। পাড়ে থাকা কংক্রিটের পিলারও উপড়ে পড়েছে। ঝড়ের ৮দিনেও পুকুরের পাড় মেরামতের তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। কবে নাগাদ পুকুর সংস্কার করা হবে তাও জানেন না স্থানীয়রা।
কথা হয় পুকুর পাড়ে থাকা ঘষিয়াখালী বাজারের ব্যবসায়ী আজাদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি সময় সংবাদকে বলেন, ‘ঘষিয়াখালী বাজারে ১৩১ টি দোকান ও ২ শতাধিক ব্যবসায়ী রয়েছেন। তারা সবাই এই পুকুরের পানি পান ও প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতেন। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ঘষিয়াখালী ও আশপাশ এলাকার অন্তত ৫ হাজার মানুষ এই পুকুরের পানি পান করেন। কিন্তু পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে যাওয়ায় খুব সমস্যায় পড়েছেন তারা।
ঘষিয়াখালী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম খলিফা সময় সংবাদকে বলেন, ‘ঝড়ে পুকুরটির পাড় ভেঙে যাওয়ার ৮দিন পরেও চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি বা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের পক্ষ থেকে কেউ পুকুরটি মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কেউ দেখতেও আসেনি। খুবই পানির কষ্টে আছেন স্থানীয়রা। দ্রুত এ এলাকায় সুপেয় পানি সরবরাহ ও পুকুর মেরামতের দাবি জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।
বাজার থেকে একটু পূর্ব দিকে গেলেই মোংলা বন্দরের ঘষিয়াখালী চ্যানেল। লোকালয় দিয়ে হেঁটে চ্যানেলের পাড়ে গেলে চোখে পড়ে এক বিশেষ দৃশ্য। স্থানীয় দুই যুবক ট্রলারে কলস নিয়ে চ্যানেলের মাঝখানে একটি জাহাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। জাহাজের কাছে যাওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন সময় সংবাদের প্রতিবেদক। যেতে যেতে ট্রলার চালক রবিউল জানালেন, ঝড়ের পর থেকে জাহাজের পানিতেই চলছে তাদের। জাহাজের মাস্টার-নাবিকদের অনুরোধ ও মাঝে মাঝে উপঢৌকন দিয়ে তারা জাহাজ থেকে পানি নেন। কয়েক মিনিটে কলস নিয়ে জাহাজে পৌঁছান রবিউল ও তার সহযোগী। জাহাজে উঠে নাবিকদের অনুমতি সাপেক্ষে জাহাজের রিজার্ভার থেকে পানি ভরলেন কলসে।
এ সময় কথা হয় জাহাজের ক্যাপ্টেন শাহজাহানের সঙ্গে। তিনি সময় সংবাদকে বলেন, মূলত মেঘনা নদী থেকে রিজার্ভারে পানি ভরে নিয়ে আসেন তারা। তাদের রিজার্ভারে ৫ থেকে ৬ হাজার লিটার পানি ধরে। একবারের ট্রিপে সব পানি ব্যবহার হয় না। তাই ঘষিয়াখালী এলাকায় যখন জাহাজ নোঙর করা থাকে তখন স্থানীয়রা কলস নিয়ে এলে তাদের পানি দেন তারা।
জাহাজ থেকে পানি সংগ্রহ করা যুবক রবিউল বলেন, মোংলা বন্দর ও খুলনা-নওয়াপাড়া এলাকায় যাওয়া-আসা করা জাহাজ যাত্রাপথে চ্যানেলের ঘষিয়াখালী এলাকায় প্রায়ই নোঙর করে। তারা আগেও বিভিন্ন সময় জাহাজ থেকে পানি সংগ্রহ করতেন। তবে ঝড়ের পরে জাহাজের পানিই একমাত্র ভরসা তাদের। এলাকার বেশিরভাগ মানুষ এখন জাহাজ থেকে পানি নেন। কেউ কেউ বিনামূল্যে নেন, আবার কেউ ছোটখাট খাদ্যপণ্য যেমন, কচু, তালশ্বাস, সিগারেট ও ছোট মুরগির বাচ্চার বিনিময়েও পানি নেন।
তবে কেউ কেউ লঞ্চে করে বাগেরহাট সদর ও রামপালের সন্ন্যাসী বাজার থেকে বোতলের পানি ক্রয় করে আনেন। তবে সে সামর্থ্য এলাকার অধিকাংশ মানুষের নেই। শুধু রবিউল নয়, এলাকার অনেক যুবকই এখন অপেক্ষায় থাকেন জাহাজ থেকে পানি সংগ্রহ করার। শুধু ঘষিয়াখালী নয়, বহরবুনিয়া ইউনিয়নের সর্বত্রই সুপেয় পানির তীব্র সংকট। সংকট রয়েছে মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা ও কচুয়া উপজেলার অধিকাংশ এলাকায়।
এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, বাগেরহাটের তথ্য অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় রেমালে এ জেলায় ২০ হাজার ২২৬টি সুপেয় পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে নলকূপ, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ট্যাংক, পিএসএফ ও পুকুর রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী জয়ন্ত মল্লিক বলেন, ঝড়ের ফলে জেলার বিপুল পরিমাণ পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সংকট মেটাতে মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলায় ৩টি ভ্রাম্যমাণ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। যা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার লিটার পানি পাচ্ছেন দুর্গত মানুষ।
তিনি আরও বলেন, বহরবুনিয়া ইউনিয়নেও তীব্র পানির সংকট রয়েছে। ইউনিয়নটিতে সরাসরি সড়কপথে কোনো যানবাহন চলে না। যার ফলে এখন পর্যন্ত সুপেয় পানির জন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। তবে যতদ্রুত সম্ভব বহরবুনিয়া ইউনিয়নের সর্বত্রই পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা।